কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল ইতিহাস-এর পিছনে রয়েছে নানা বিধ কারণ। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প এবং নদীয়ার ঘূর্ণি অঞ্চলের, কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল ( ghurni krishnanagar matir putul ) রাজ্য, দেশ তথা বিশ্বে সু-বিখ্যাত। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ও সুখ্যাতি কুটির শিল্প নদীয়ার কৃষ্ণনগর অঞ্চল । কৃষ্ণনগরের পুতুল প্রধানত তৈরি হয় কৃষ্ণনগরের কিছুটা পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘূর্ণিতে। বিভিন্ন কোমরের হাতে তৈরি মূর্তি গুলোর মধ্যে মানুষের বাস্তব জীবনের পরিস্থিতির মনোভাব পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে। আজকে আপনাদের কিভাবে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল তৈরি শুরু হলো শেয়ার করব।
“কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল
তোমার বিশ্বজোড়া নাম,
তাইতো তুমি!
বহু মানুষের কাছে পাও সুনাম।”
দক্ষ শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় প্রতিটি মূর্তি থেকে শুরু করে পুতুল, খেলনা সবকিছুই খুবই সূক্ষ্ম হাতে তৈরি করা। কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল সত্যিই যেন মানুষের জীবন্ত হয়ে কথা বলতে চাই। সারা বিশ্বের দুয়ারে তথা দুনিয়া জুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল।
Table of Contents
মৃৎশিল্পের উদ্ভবে নদীয়ার রাজার ভূমিকা :
আনুমানিকভাবে বলা যায়, কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল তৈরি প্রায় ৩০০বছরেরও আগে ব্রিটিশ আমলে বাংলার গভর্নর জেনারেল রাজস্ব আদায়ের জন্য ভারতে আসেন এবং তখন নদীয়ার কৃষ্ণনগর ভ্রমণ করতে যান । কৃষ্ণনগরের কুমোরের তৈরি বিভিন্ন ধরনের মাটির জিনিস দেখে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের খুবই প্রশংসা করেন ।
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল ইতিহাস শুরু হয়েছিল প্রায় ১৯ এর দশক থেকেই। চৈতন্যদেব গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেবের গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের মূলস্থান গুলি হল- নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর, নবদ্বীপ এবং শান্তিপুর। কৃষ্ণনগর এর রাজা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়কাল থেকে কৃষ্ণনগরে সংস্কৃতির মূল স্থান হয়ে দাঁড়ায় এই কৃষ্ণনগর এর বিভিন্ন এলাকা। কৃষ্ণনগরের ঘুর্নির অঞ্চলের কুমোরের তৈরি হাতের কাজের কথা তৎকালীন কিংবা বর্তমান সমাজ-এ বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে। কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল পৃথিবী বিখ্যাত। নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই মৃৎশিল্পের বিকাশে কতখানি ভূমিকা নিয়েছিল আজকে আপনাদের জানাবো।
কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের শিল্পনির্মাণ শুধুমাত্র রাজ্য কিংবা দেশ -এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। শিল্প অনুরাগী বহু মানুষ আমেরিকা,ইউরোপ ও ব্রিটিশ থেকে অনেক মূল্য দিয়ে কৃষ্ণনগরের মৃৎ শিল্পীদের করা অনেক মাটির জিনিস কিনে নিয়ে যান। তাই বিশ্বের দরবারে কৃষ্ণনগর এলাকার মাটির পুতুল বিশেষ বিখ্যাত ও সুখ্যাতি অর্জন করেছে। পুতুল নিয়ে সেই কবিতাটা বেশ মনে পড়ে যায়-
পুতুল, তুমি পুতুল ওগো!
কাদের খেলা-ঘরের ছোট্ট খুকু,
পুতুল নেবে গো,পুতুল।
নদীয়ার কৃষ্ণনগরের আগের নাম ছিল রেউই। অনেক তথ্য থেকে জানা যায় কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম অনুসারেই বর্তমান কৃষ্ণনগরের নামকরণ হয়। লোকোমুখি শোনা যায় নদীয়ার রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র নাকি এই নামকরণ করেননি, করেছেন কৃষ্ণচন্দ্রের আগের রাজা। বর্তমানে নদীয়ার কৃষ্ণনগর শিক্ষা সংস্কৃতির দিকে অনেক এগিয়ে। এই শিক্ষা সংস্কৃতি এত অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়কাল থেকেই।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়ি দেওয়াল এমন কি উঠোন, দালান তার বাড়িতে থাকা নানা দেবদেবীর মূর্তি সবই কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীর তৈরি করা জিনিস। মিৎশিল্পীরা উন্নত ও দেব-দেবী রুপায়নের কাজ শুরু করে কৃষ্ণচন্দ্রের পর থেকেই।
কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা সর্বপ্রথম দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণে তাদের নিপুন দক্ষতার পরিচয় দেন। নদীয়ার মানুষজনের উৎসব কিংবা পার্বণের প্রতি আগ্রহের বিষয়টি ছিল শিল্পীর অগ্রগতির মূল কারণ।
কৃষ্ণনগরের মাটি/মৃত্তিকা:
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল তৈরির জন্য অনুকূল মাটি কৃষ্ণনগরে রয়েছে। কৃষ্ণনগরের মাটি মৃৎশিল্পের জন্য বিশেষ উপযোগী। কারণ এখানকার মাটিতে বেলে মাটি ও দোআঁশ মাটির মিশ্রণ রয়েছে যা মাটির পুতুল তৈরি করতে বিশেষ উপযোগী। সব রকম মাটির মিশ্রণ এই মাটিতে থাকায় কৃষ্ণনগরের মাটিতে খুব ভালো মাটির তৈরি পুতুল কিংবা মূর্তি কুমোরেরা বানাতে পারতো। গাছ ভালো না হলে যেমন ফল ভালো হয় না ঠিক তেমনি মাটি ভালো না হলে মাটির তৈরি কোন জিনিসই ভালো হবে না। তাই যে কোন মাটির জিনিস বানাতে গেলে মাটি কেটে গেলে কোন মাটির জিনিস সূক্ষ্ম হবে না আর মাটি ভালো হলে মূর্তি ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে এবং খুব নিপুণভাবে মূর্তি কিংবা পুতুল তৈরি করা যায়।
কোন শ্রেণীর মানুষ মৃৎশিল্পী ছিলেন:
সাধারণত মাটির তৈরি থালা, বাটি, গ্লাস, কলসি, হাড়ি যে সমস্ত শিল্পীরা তৈরি করেন সেই কুমোর মানুষেরাই আস্তে আস্তে বড় বড় প্রতিমা বানিয়ে মৃৎ শিল্পী হয়ে উঠেছেন। তবে সব কুমোরেরা নিপুণ মৃৎশিল্পী হতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলায় যে শুধুমাত্র কুমোরা এই সুন্দর মূর্তি করত এমনটা কিন্তু নয়, অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মূর্তি মাটির পুতুল ইত্যাদি তৈরি করতো।
কলকাতা, উত্তর দক্ষিণ ২৪ পরগনা , মুর্শিদাবাদ,নদিয়া এইসব অঞ্চলে মূর্তি কিংবা মাটির জিনিস তৈরি করত পাল বংশধারী মানুষেরা। রাঢ় দেশের সাধারণত সূত্রধর শ্রেণীভুক্ত লোকেরাই জলপাইগুড়ি, কোচবিহার. উত্তর দিনাজপুর ,দক্ষিণ দিনাজপুর এইসব এলাকায় মূর্তি কিংবা মাটির জিনিসপত্র তৈরি করতো রাজবংশীরা। বর্তমানে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে পাল বংশের কুমোরেরা ছাড়াও অনেক বংশের মানুষেরা মৃৎশিল্পী হয়ে উঠেছেন।
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল ইতিহাস:
কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীর সৃষ্টি নদীয়া রাজ বংশের হাত ধরে। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দীর্ঘ মূর্তি নির্মাণে তাদের কল্পনা শক্তির বিশেষ প্রয়োগ ঘটাতেন। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই নবদ্বীপে বৈষ্ণব কীর্তন এর জন্য রাজ যাত্রার প্রচলন করেন এবং সেখানে তৈরি বিভিন্ন ধরনের মূর্তি তৈরি করেন কৃষ্ণনগরের কুমোরেরাই।। আমরা যে কালী মায়ের কিংবা দুর্গা মায়ের নানা ধরনের মূর্তি দেখি সবই নিপুনভাবে একজন মৃৎশিল্পী তার কল্পনা দিয়েই গড়ে তোলেন। দেব দেবীর মূর্তি তৈরি হলেও কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল এটিই বিশ্ব বিখ্যাত।
বর্তমানে কৃষ্ণনগরে নারী পুরুষ সকলেই মৃৎশিল্পী হয়ে উঠেছেন। নারী পুরুষ তার কল্পনা শক্তির জোরেই একজন খ্যাতিনামা মৃৎ শিল্পী হয়ে ওঠেন। পুরুষেরা মূর্তি তৈরি করলেও নারীরা বিশেষত ছাঁচের তৈরি বাসনপত্র থেকে মূর্তি তৈরি করতে সক্ষম। মহিলারা বিশেষত্ব তৈরি করেন মাটির পুতুল খেলনা, হাড়ি, কলসি, চাকের নানা ধরনের মাটির জিনিসপত্র। কুমোরদের যেহেতু মাটির জিনিস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাই,মৃৎশিল্পীরা প্রধানত বাজার চলতি জিনিস অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের মাটির জিনিস (যেমন-পুতুল থেকে মূর্তি এবং বাড়ির ব্যবহৃত জিনিস) তৈরি করেন।
মৃৎশিল্পের বিকাশ
নদীয়ার কৃষ্ণনগরে মৃৎ শিল্পের বিকাশে দক্ষ কারিগরের পাশাপাশি নানা পুস্তক, নানা একাডেমী, নানা মেলা এগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। অনেক সাহিত্যিক তাদের নিজের পুস্তকে মৃৎশিল্পের কথা লিখেছেন এবং কারিগরদের সুনাম করেছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নদীয়ার কৃষ্ণনগরের মৃৎ শিল্পীদের অনেক সুনাম করেছেন এবং অগ্রগতির পথ দেখিয়েছেন।
মৃৎশিল্প নিয়ে লেখা নানা পুস্তক
শুধুমাত্র মাটির জিনিস তৈরি করলেই হয় না। তার বিকাশের জন্য প্রচারও করতে হয়। আর এই মৃৎ শিল্পীদের প্রচার গণমাধ্যমে করার জন্য পত্রিকা থেকে শুরু করে বই এমন কি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের উদ্ভবের বিকাশ অনেকাংশই রয়েছে। প্রখ্যাত সাহিত্যবিদ প্রফুল্ল সরকার “ভারতবর্ষ” পত্রিকায় কৃষ্ণনগর রাজপরিবার সম্বন্ধে লিখেছেন যে,
”কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল আরম্ভ হইয়াছিল কৃষ্ণনগরের রাজার জন্য ‘নরনারী কুঞ্জর’ গঠন হইতে নয়টি নারী পুতুলের সমষ্টিতে করা হইয়াছিল এই অভূত পুতুল। বিখ্যাত মৃৎশিল্পী যদুপালের পূর্বপুরুষ গোপাল পালইহার স্রষ্টা।”
পাল বংশধারী মানুষেরাই কৃষ্ণনগরে মৃৎশিল্পী ছিলেন তা আমরা বহু বই এবং সংবাদপত্রে পাই। কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পী সঙ্গে সমগ্র ভারতের কিংবা তথা বিশ্বে পরিচয় ঘটানোর ক্ষেত্রে একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। একটা সময় তিনি যখন ভারতীয় প্রদর্শনী বিভাগের মুখ্য পরিচালক ছিলেন সেই সময় বিভিন্ন অঞ্চলের কারুশিল্প ও শিল্পীদের সাথে তার পরিচয় ঘটে। ক্যালকাটা ন্যাশনাল এক্সিবিশানের জন্য তিনি বিভিন্ন কারুশিল্পীদের নিদর্শন সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। সেই সময় কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীদের সাথে তার পরিচয় ঘটে।
ত্রৈলোক মুখোপাধ্যায় তার ‘আর্ট ম্যানুফ্যাকচারস অফ ইন্ডিয়া‘ বইতে কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন মৃৎশিল্পীদের কথা তুলে ধরেন। এই মানুষটির সাহায্যেই কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন মৃৎ শিল্পীদের উদ্যোগ এবং প্রচেষ্টায় ভারত তথা সারা বিশ্বে কৃষ্ণনগরের মৃৎ শিল্পীদের প্রখ্যাত সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
কোন অঞ্চলে মাটির পুতুল পাওয়া যায়
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণিতে বেশি পরিমাণে মৃৎ শিল্পীরা তৈরি করেন। কৃষ্ণনগরে মাটির পুতুল তৈরি করেন প্রায় ৫০০র বেশি পরিবার তার মধ্যে, ঘূর্ণি অঞ্চলের প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ বাড়ির মানুষেরা মাটির পুতুল তৈরি করেন|
মৃৎ শিল্পীদের পরিচয়
কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীকে বিশ্বের দরবারে তথা উচ্চতর শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন প্রখ্যাত ব্যক্তি যদুনাথ পাল। যদুনাথ পাল রবীন্দ্রনাথের সামনে বসেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন। সেই মূর্তি এতটাই সুন্দর হয়েছিল, যে যদুনাথ পাল এর নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়েপড়েছিল এবং তার সুনাম সারা বিশ্ব করেছে।সেই সময় থেকেই বিশ্বের নানা নাম জাদা মানুষের সাথে যদুনাথ পালের পরিচয় হয়।
আরো পড়ুন: আজও ২০২৪ সালে কি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বেঁচে আছেন? জেনে নিন
পাল বংশের সর্বপ্রথম যে মৃৎশিল্পী পুরস্কার পান তিনি হলেন শ্রীরাম পাল। শ্রীরাম পালের বর্তমান বংশধর রাখাল দাস পাল এবং নয়ন দাস পাল নিপুন হাতে মাটির জিনিস তৈরি করতেন। রাখাল দাস পাল বহুদিন আগে একটি মাটির তৈরি মূর্তি বানিয়ে ত্রৈলোক্যনাথের হাতে আসামের জমিদারকে দিয়ে পাঠান। আসামের জমিদারের তথা সেই অঞ্চলের খ্যাতিমান মানুষের সেই মাটির মূর্তিটা ভীষণ পছন্দ হয়েছিল এবং সবাই মৃৎ শিল্পী রাখাল দাস পালের খুব প্রশংসা করেছিল। তারপর থেকেই পাল বংশের মৃৎ শিল্পীদের নাম দেশ তথা সারা বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে নদীয়ার কৃষ্ণনগরেই পাল বংশ ছাড়াও অন্যান্য বংশের মানুষেরাও বিশেষ নিপুনতার সাথে মাটির পুতুল তৈরি করেন এবং তারাও বর্তমানে দক্ষ কারিগর হয়ে উঠেছেন। এমনকি বড় বড় প্রতিমা নির্মাণেও তারা দক্ষ ও সুনিপুণ হয়ে উঠেছে।
নকশা:
পুতুলগুলি ভাগীরথী নদীর মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়।একে বলা হয় এটেল। কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলগুলি তাদের দৈনন্দিন গ্রামের জীবন- মাছ ধরা, কৃষিকাজ, ঝুড়ি তৈরি, রান্না করা এবং পূজা করা ইত্যাদির জন্য বিখ্যাত।
মৃৎশিল্পীদের কারুকার্য
প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী কার্তিক চন্দ্র রবীন্দ্র সদনের সামনে বসানো ব্রঞ্চের রবীন্দ্রনাথের মূর্তি নির্মাণ করেছেন | বিশেষ দক্ষ নিপুণতার সাথে এবং মন দিয়ে তিনি কাজটি করেছিলেন তাই আজও মূর্তিতেই স্ব-স্থানে দণ্ডায়মান।। বেলুড় মঠের পাথরের তৈরি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মূর্তি করেছেন বিখ্যাত জে সি পাল। কৃষ্ণনগরের বহু মৃৎশিল্পী কলকাতার কুমোরটুলিতে বিশেষ নিপুণতার সাথে নানা ধরনের ছোটদের খেলনা থেকে শুরু করে দেব দেবীর মূর্তি এবং মাটির জিনিস তৈরি করেন।
আরো পড়ুন: জানলে অবাক হবেন ২৬ শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস কেন পালিত হয়
কুমোরটুলিতে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল তৈরি একজন বিখ্যাত মৃৎশিল্পী হলেন – গোপেশ্বর। কলকাতার একজন সফল মৃৎ শিল্পী হিসেবে বিশ্বের দরবারে তার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। গোপেশ্বর একজন মৃৎশিল্পী হিসাবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। কার্তিক চন্দ্র পাল সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তি ঋষি অরবিন্দের মূর্তি এই ধরনের নানা মূর্তি বানিয়ে তিনি সুবিখ্যাত হয়ে ওঠেন | যদুনাথ পাল নানা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার পান|
মাটির পুতুল নির্মাণ
জলঙ্গি এবং ভাগীরথী এই দুটি নদীর পাড় থেকে পুতুল নির্মাণের জন্য মাটি সংগ্রহ করা হয়। তারপর এই মাটি পুতুল নির্মাণের বিশেষ কয়েকটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটির জিনিস তৈরীর উপযোগী করে তোলা হয়। এই মাটি থেকে শিল্পী তার নিজের হাতের কারুকার্যে পুতুল নির্মাণ করেন প্রথমে পুতুলটিকে রৌদ্রে শুকিয়ে নেওয়া হয় তারপর বিভিন্ন ধরনের রং করে দোকানে বিক্রয় করে।
পুতুলে ব্যবহৃত রং
মানুষ যেহেতু চটকদার রঙে বেশি পছন্দ করেন। সেই মতো এখানকার শিল্পীরা পুতুল গুলিতে নানা ধরনের রং ব্যবহার করে থাকেন। পুতুলগুলো মূলত তীব্র রং করা হয়ে থাকে। প্রথমে প্রাইমার দিয়ে তারপর নানা ধরনের যেমন- সাদা, লালচে খয়রি, কালো, লাল , নীল এবং সবুজ ইত্যাদি করা হয়।
মাটির পুতুলের বৈশিষ্ট্য
- কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল গুলো সাধারণত সাধারণ বাঙালি নারী-পুরুষকে বন্দী করে।
- এই পুতুলগুলি কারিগরের দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিভিন্ন আবেগ এবং বস্তুর বাস্তবসম্মত উপস্থাপনা প্রদর্শন করে। যে কেউ এই পুতুলগুলি দেখে সহজেই দৃশ্যকল্পটি ব্যাখ্যা করতে পারে এবং অনুভব করতে পারে সেই কারিগর চিত্রিত করতে চায়।
- আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খাওয়া, ঘুমানো, গ্রামীণ জীবনের সারাদিনই কাজ সবকিছুই এখানকার মৃৎশিল্পীদের হাতে নিপুণতার সাথে ফুটে ওঠে।
- মাটির তৈরি দেবদেবীর মুক্তি গুলো বিশেষ বিশেষ দিকে নির্দেশ করে।
- মাটির তৈরি পুতুলগুলোর রং বিশেষভাবে করা হয়। যার ফলে পুতুলগুলো দেখতে খুব সুন্দর হয়।
- প্রতিটি মানুষেরই দৈনন্দিন জীবনে সুখ দুঃখ আসে যায়। মৃৎশিল্পীরা মানুষের মনের পরিস্থিতি অনুযায়ীও তাদের মূর্তিগুলো নির্মাণ করে থাকেন।
- চমৎকার ভাবে কারুকাজ করা, এই মাটির পুতুল এবং বিভিন্ন আকারের মূর্তিগুলি তাদের চারপাশের জীবনের বাস্তব-জীবনের বর্ণনা দিয়ে সমর্থক এবং সাধারণ মানুষকে একইভাবে আনন্দিত করেছে।
- দেব দেবীর মূর্তি ঘরের ঘর মাটির ঘর পাকার ঘর প্রতিটি সবজি থেকে শুরু করে ফল বিশেষ নিপুণতার সাথে এখানকার শিল্পীরা করে থাকেন।।
- এই নৈপুণ্যের সাথে জড়িত মডেল তৈরি সম্পূর্ণরূপে কারিগরের হাতের দক্ষতার উপর নির্ভর করে ।
- ধরনের ছোট বড় মাঝারি সব রকমের মাটির জিনিসই কৃষ্ণনগরে তৈরি করা হয়। বাজারের চাহিদা রেখে পুতুল তৈরি করা এখানকার কুমোরদের পুতুল তৈরির প্রধান বৈশিষ্ট্য।
- বর্তমানে সমাজ যেহেতু আধুনিকতার শীর্ষস্থানে পৌঁছেছে। সেই মতো মৃৎশিল্পীরাও তাদের শিল্পে আধুনিকতার ছোঁয়া রন্ধে রন্ধে রেখেছেন।
- পাচ্য ও পাশ্চাত্যের যুগলবন্দী হয়ে গড়ে ওঠে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল।
বাজারে মাটির পুতুলের চাহিদা
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলের চাহিদা বিশ্বজোড়া । ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এই রপ্তানি করা হয়। দেশের বাইরে প্রধানত ইউরোপ উত্তর আমেরিকাতে পুতুল রপ্তানি বেশি হয়। তবে সরকারি দপ্তর থেকে এর প্রচার খুবই কম। শিল্পীরা আর্থিক সহযোগিতা না পেয়ে উপযুক্ত প্রচারের অভাব অনুভব করছে। এছাড়া অনেক সময় অন্য জায়গায় শিল্পীরা তাদের মাটির পুতুল ”কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল” বলে বাজারে বিক্রি করছেন। আশা করা যায় এই সমস্যার সমাধান খুব তাড়াতাড়ি হবে।
আপনারা বাংলার মাটির পুতুলের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে অবশ্যই কমেন্ট করবেন।
2 thoughts on “কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল ইতিহাস- মৃৎশিল্প ও শিল্পী”