রুই মাছ আমাদের দেশের অতি পরিচিত সুস্বাদু মাছ। আজ আমরা জানবো রুই মাছের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে| রুই মাছ মেজর কার্প জাতীয় মাছ। রুই মাছের বিজ্ঞানসম্মত নাম হচ্ছে Labeo rohita এবং ইংরেজি নাম হচ্ছে Rohu Carp| মিষ্টি জলের যেসব মাছের মাথায় আঁইশ থাকে না কিন্তু সারা দেহ সাইক্লয়েড (cycloid) আঁশ দিয়ে আবৃত থাকে, দেহগহ্বরে পটকা থাকে তাদের কার্প (carp) জাতীয় মাছ বলে। কার্প জাতীয় মাছের মধ্যে যেগুলো আকৃতিতে বড়, দ্রুত বর্ধনশীল এবং বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোকে বলে মেজর কার্প।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এসব নদীতে এমনকি খালে, বিলে, পুকুরে রয়েছে হাজারো রকমের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের মাছ। তাই এদেশে জন্মানো প্রতিটি মানুষের সাথেই মাছ সরাসরিভাবে জড়িত। বাংলাদেশ ও ভারতে বহুল পরিচিত ও সুস্বাদু মাছের মধ্যে রুই মাছ অন্যতম। রুই একটি দ্রুত বর্ধনশীল মাছ |
রুই মাছের সাধারণ বৈশিষ্ট্য:
এখানে রুই মাছের কিছু সাধারন বৈশিষ্ট্য দেওয়া হলোঃ
- এই মাছ দেখতে অনেকটা চ্যাপ্টা আকৃতির হয়ে থাকে।
- রুই মাছ সাধারণত একটি মিষ্টি জলের মাছ।
- এই মাছটি পুকুর, নদী ও হ্রদ এই জায়গাগুলিতে পাওয়া যায়। এবং এই রুই মাছ স্থির জলে থাকতে পছন্দ করে।
- এই মাছ জলের মধ্যে থাকা ছোট ছোট মাছ, শ্যাওলা ও জলের মধ্যে থাকা বিভিন্ন পোকা মাকড় খেয়ে থাকে। রুই মাছ বর্ষাকালের দিকে জুন-জুলাই মাসে ডিম ছেড়ে থাকে।
রুই মাছের বসতি:
রুই মাছ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও মায়ানমারের নানা জায়গায় রুই মাছের বসতি। মিষ্টি জল যেমন-পুকুর, নদী, হ্রদ ও মোহনায় রুই মাছ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় নদীতে এই মাছ বিচর করে এবং ডিম ছাড়ার সময় প্লাবনভূমিতে প্রবেশ করে। স্বাদ, সহজ চাষপদ্ধতি, অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং পুষ্টি ঘাটতি মেটাতে শ্রীলংকা, নেপাল, রাশিয়ান, জাপান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া ও আফ্রিকান দেশগুলোতে রুই মাছের চাষ বর্তমানে বেশি পরিমাণে হচ্ছে। ইন্ডিয়ান আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের মিষ্টি জলের নদীতেও নদীতে ও প্রবেশকারী রুই মাছের চাষ অত্যাধিক পরিমাণে বর্তমানে করা হচ্ছে।
রুই মাছ ও রুই মাছের শ্রেণিবিন্যাসঃ
রুই মাছের Phylum- পর্ব | Chordata (জীবনের কোনো না কোনো দশায় নটোকর্ড, পৃষ্ঠীয় স্নায়ুরজ্জু ও গলবিলীয় ফুলকা বন্ধ থাকে) |
রুই মাছের Sub-Phylum-উপপর্ব | Vertebrata/ ভার্টিব্রাটা (নটোকর্ড মেরুদণ্ড দিয়ে প্রতিস্থাপিত) |
শ্রেণি বা Class | Actinopterygii (রশ্মিযুক্ত পাখনা) |
বর্গ বা Order | Cypriniformes (পার্শ্বরেখা সংবেদী অঙ্গ লেজের শীর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত) |
রুই মাছ কোন পরিবার বা Family | Cyprinidae (ভোমার দাঁতবিহীন, গলবিলীয় কর্তন আল উপস্থিত) |
Genus (গণ): | Labeo |
বিজ্ঞানসম্মত নাম বা scientific name | Labeo Rohita |
রুই মাছের খাদ্যাভাস:
প্ল্যাঙ্কটন জাতীয় খাবার যেমন ডেস্মিড, ফাইটোফ্লাজিলেট, শৈবাল রেনু ইত্যাদি খায় (আঙ্গুলিপনা দশায়)|
প্রধানত শাকাশি জাতীয় (তরুন ও পূর্ণবয়স্ক মাছ) |
জলজ উদ্ভিদ, আগাছা এবং মাঝে মাঝে জলের তলদেশ থেকে পঁচা জৈব পদার্থ খেয়ে জীবনধারণ করে|
ফিসমিল, খৈলের গুঁড়া, কুঁড়া ইত্যাদি পুকুরে চাষের সময় সম্পূরক খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
খাবার পিষে ফেলতে সাহায্য করে ধারালো দাঁত|
অতিক্ষুদ্র প্ল্যাঙ্কটনও ছেঁকে খায়( ফুলকা র্যাকারের সাহায্যে)|
জীবন চক্র:
জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে রুইয়ের পছন্দের আহার হলো প্ল্যাংকটন জাতীয় অর্থাৎ প্রাণীপ্ল্যাংকটন এবং উদ্ভিদপ্ল্যাংকটন জীব। আঙ্গুলিপোনা দশায় প্রধানত প্রাণীপ্ল্যাংকটন গ্রহণ করলেও শৈবালও গ্রহণ করে। পূর্ণবয়স্ক মাছ জলের মাঝ স্তরের শৈবাল ও নিমজ্জিত উদ্ভিদ বেশি গ্রহণ করে।খুটে খাওয়ার উপযোগী নরম ঠোঁট এবং মুখ-গলবিলীয় অঞ্চলে দাঁতের বদলে ধারাল আলদেখে বোঝা যায় রুই মাছ নরম জলজ উদ্ভিদ খেয়ে থাকে। ফুলকায় সরু চুলের মতো ফুলকা – রেকার দেখে প্রমাণ পাওয়া যায় এই মাছ অতিক্ষুদ্র প্ল্যাংক্টনও ছেকে খায়। রুই মাছের পোনা গুলো ঝাঁক বেধে চলে, প্রাপ্ত বয়স্ক মাছ সাধারণত পৃথক জীবন অতিবাহিত করে। রুই মাছ ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচের তাপমাত্রায় বাঁচতে পারে না।
রুই মাছের বাহ্যিক গঠন:
রুই মাছের দেহ তিনভাগে বিভক্ত। যেমন:
- মাথা
- দেহকান্ড
- লেজ
রুই মাছের মাথা চারটি অংশ নিয়ে গঠিত। যেমন:
- মুখ: এই মাছের মুখ নিচের দিকে অবস্থিত, মুখের দুই কোনা পিছনের দিকে বাঁকা হওয়াতে মুখ অর্ধচন্দ্রাকার এবং থুঁতনি ভোঁতা, নিচু, কদাচিৎ স্ফীত। মুখের নিচে ও উপরে ঝালরের মত ঠোঁট আছে। থুঁতনির পৃষ্ঠদেশের চোখের সামান্য সম্মুখে একজোড়া নাসারন্ধ্র আছে|
- চোখ: মাথার দুই পাশে ১ টি করে মোট ২ টি বড় বড় চোখ আছে। চোখে কোন পাতা নেই, কর্নিয়া স্বচ্ছ চামড়ার আবরণ দ্বারা আবৃত।
- নাসারন্ধ্র: মাছের তুণ্ডের পৃষ্ঠদেশে দুচোখের একটু সামনে রয়েছে একজোড়া নাসারন্ধ্র |
- লাল লাল কানকো থাকে|
মাথার বৈশিষ্ট্য:
- রুই মাছের দেহের অগ্রভাগ থেকে কানকোর পশ্চাত প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত।
- ৪-৫ ইঞ্চি লম্বা; অর্ধচন্দ্রাকার।
- পৃষ্ঠভাগ উত্তল।
- তুণ্ড ভোঁতা ।
- মোটা ঝালরের মত ওষ্ঠ ।
- ঊর্ধ চোয়ালে ম্যক্সিলারি বার্বেল থাকে।
- মাথায় একজোড়া নাসারন্ধ্র থাকে।
- মাছের চোখের পাতা নেই; কর্নিয়া আবৃত থাকে।
- রুই মাছের মাথা আইশ বিহীন হয়।
- কানকোর নিচে ব্রাঙ্কিওস্টেগাল পর্দা থাকে।
দেহকান্ড :
কানকোর শেষ ভাগ থেকে পায়ু পর্যন্ত দেহের মধ্য অংশটি দেহকাণ্ড।
রুই মাছের দেহ কাণ্ডের বৈশিষ্ট্য:
১.এ অংশটি চওড়া এবং বিভিন্ন ধরনের পাখনা বহন করে।
২.পাখনাগুলো পূর্ণ বিকশিত এবং অস্থিময় পাখনা-রশ্মি যুক্ত।
৩.দেহকান্ডের পশ্চাৎপ্রান্তের অঙ্কীয় দিকে ঠিক মাঝ বরাবর তিনটি ছোট ছিদ্র থাকে:
- ১.প্রথমে পায়ুছিদ্র,
- ২.মাঝে জননছিদ্র এবং
- ৩.সবশেষে রেচনছিদ্র।
পাখনা ৫ ধরনের:
- ১.পৃষ্ঠপাখনা (Dorsal fin) : এই মাছের দেহকাণ্ডের মাঝ বরাবরের পিছনে বড়, কিছুটা রম্বস আকারের একটি মাত্র পৃষ্ঠ পাখনা রয়েছে । এর উপরের দিকের মধ্যভাগ অবতল এবং এখানে ১৪-১৬টি পাখনা-রশ্মি থাকে।
- ২.বক্ষ পাখনা(Pectoral fin) : একজোড়া; কানকোর পিছনে দেহকান্ডের সম্মুখ পার্শ্বদিকে অবস্থিত; ১৭-১৮ টি পাখনা রশ্মি আছে|
- ৩.পায়ু পাখনা (Anal fin) : একটি; পায়ুর ঠিক পিছনে দেহের অঙ্কদেশের মাঝখান বরাবর অবস্থিত; ৬-৭ টি পাখনা রশ্মি যুক্ত |
- ৪.পুচ্ছ পাখনা (Caudal fin) : লেজের পিছনে অবস্থিত; ১৯ টি পাখনা রশ্মি|
- ৫.দল পাখনা: বৃক্ষ পাখনার নিচে অবস্থিত|
রুই মাছের পাখনার কাজ:
১.বক্ষ পাখনা একজোড়া:
মাছকে জলে স্থির এবং জলে ওঠানামা করতে সাহায্য করে|
২.দল পাখনাএকজোড়:
বক্ষ পাখনার সাথে মিলিতভাবে মাছকে জলের স্থির এবং ওঠানামা করতে সাহায্য করে।|
৩.চিত্র পাখনা একজোড়া:
সন্তর সময় দেহের সামর্থ পরিচালনা এবং এগিয়ে যেতে সাহায্য করে|
৪.পায়ু পাখনা:
দেহের ভারসাম্য বজায় রাখে|
৫.পুচ্ছ পাখনা:
মাছের দিক পরিবর্তনের সাহায্য করে এই পুচ্ছ পাখনা|
লেজ (Tail) :
পায়ুর পরবর্তী অংশটি হল লেজ। এর শীর্ষে রয়েছে হোমোসার্কাল ধরনের পুচ্ছ-পাখনা। এটি উল্লম্বতলে প্রসারিত এবং পিছনে, উপরে ও নিচে দুটি প্রতিসম বাহ্যিক খণ্ডে বিভক্ত। ডার্মাল রশ্মিগুলো উপরে ও নিচের খণ্ডে বড়, মাঝখানে ছোট।
রুই মাছের লেজের বৈশিষ্ট্য:
- পায়ুর পরবর্তী অংশ
- শীর্ষে থাকে হোমোসার্কাল ধরনের পুচ্ছপাখনা
- উল্লম্বতলে প্রসারিত
- ডার্মাল রশ্মি উপরে ও নিচে বড়, মাঝখানে ছোট
মাছের আইশ:
- রুইমাছের দেহকাণ্ড ও লেজ মিউকাসময় সাইক্লয়েড (cycloid) ধরনের ( কারণ গোলাকৃতি) আঁইশে আবৃত। এগুলো পাতলা, প্রায় গোল ও রুপালী চকচকে।
- কেন্দ্র লালচে, প্রান্ত কালো রঙের হয়
- উপরিভাগে উঁচু আল ও নিচু খাদ তৈরি হয়
- উন্মুক্ত অংশে বৃদ্ধি রেখা ও রঞ্জক কোষ থাকে
- স্তরগুলোর কেন্দ্রটি হচ্ছে ফোকাস। এটি সাধারণত একপাশে থাকে।
- উঁচু আলগুলোকে বলে সার্কুলাস বা বৃদ্ধি রেখা । এগুলোর সাহায়্যে বাৎসরিক বৃদ্ধির ও বিভিন্ন ঋতুতে বৃদ্ধি সম্মন্ধে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যায়। সাধারণত বসন্তকালে ও গ্রীস্ম কালে আঁইশের বৃদ্ধি হয়।
- এছাড়া এই আঁইশগুলো পরস্পরকে আংশিক ঢেকে লম্বালম্বি ও কোণাকুণি সারিতে বিন্যস্ত থাকে।
- আঁইশগুলো সবসময় মিউকাসের পাতলা পিচ্ছিল আস্তরণ দিয়ে আবৃত থাকে। এবং এর মাথার দুই পাশে ৪ জোড়া ফুলকা রয়েছে |
রুই মাছের রক্তের বৈশিষ্ট্যঃ
- রক্তবাহিকা বিস্তৃত এবং হৃৎপিণ্ড নিয়ে নিয়ন্ত্রিত এ তন্ত্রের মাধ্যমে রক্ত দেহের বিভিন্ন অংশে সঞ্চালিত হয়। রুই মাছের রক্তের রং লাল|
- এটি রক্তরস (plasma) ও রক্তকণিকা নিয়ে গঠিত।
রক্তকনিকা দুই প্রকার যথাঃ
১। লোহিত রক্তকণিকা
২। শ্বেত রক্তকণিকা
লোহিত রক্তকণিকা
- লোহিত রক্তকণিকা ডিম্বাকার হয়ডিম্বাকার|
- এতে থাকে নিউক্লিয়াস|
শ্বেত রক্তকণিকা
- শ্বেতকণিকা দেখতে অ্যামিবার মতো (amoeboid)।
- হৃৎপিন্ড, ধমনি, শিরা ও কৈশিকনালির সমন্বয়ে Labeo-র রক্ত সংবহনতন্ত্র গঠিত।
রক্ত সংবহনতন্ত্র তিনটি তন্ত্র নিয়ে গঠিত। যথাঃ
- হৃৎপিণ্ড
- ধমনিতন্ত্র
- শিরাতন্ত্র
রুই মাছের হৃদপিণ্ডের অবস্থান:
- রুই মাছের ফুলকা দুইটির পেছনে পেরিকারডিয়াল গহ্বর নামে বিশেষ এক গহ্বরে হৃদপিণ্ডের অবস্থান।
হৃদপিণ্ডের গঠন:
রুই মাছের হৃদপিণ্ডের দুইটি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। যথা:
- অ্যাট্রিয়াম
- ভেন্ট্রিকল
রুই মাছের সাইনাস ভেনেসাস নামের একটি উপপ্রকোষ্ঠও রয়েছে।
সাইনাস ভেনেসাস:
- পাতলা প্রাচীর বিশিষ্ট।
- সাইনো-অ্যাট্রিয়াল ছিদ্রের মাধ্যমে আট্রিয়ামের সাথে যুক্ত থাকে।
- হৃদপিণ্ডের পৃষ্ঠদেশে অবস্থিত।
অ্যাট্রিয়াম:
- হৃদপিণ্ডের সবচেয়ে বড় প্রকোষ্ঠ
- পেরকারডিয়াল গহ্বরের পৃষ্ঠদেশের সামনের দিকে অবস্থান করে
- একদিকে সাইনাস ভেনেসাস এবং আরেকদিকে অ্যাট্রিও-ভেন্ট্রিকুলার ছিদ্রপথের সাথে যুক্ত থাকে।
ভেন্ট্রিকল:
- হৃদপিণ্ডের সর্বশেষ প্রকোষ্ঠ
- প্রাচীর থাকে বেশ পুরু এবং মাংসল
- পেরিকার্ডিয়াল গহ্বরের পিছন দিকে থাকে
বাল্বাস আরটারিওসাস:
- ভেন্ট্রিকল থেকে ভেন্ট্রাল অ্যাওর্টার মাঝখানে একটি স্ফীত অংশ
- হৃদপিণ্ডের কোন অংশ নয়
- ভেন্ট্রাল অ্যাওর্টারই স্ফীত হওয়া গোঁড়া বা মূল
- হৃদপিণ্ড থেকে ভেন্ট্রাল অ্যাওর্টায় রক্ত চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে
রুই মাছের হৃদপিন্ডের কপাটিকাসমূহ (Valves):
- হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠ ও উপপ্রকোষ্ঠগুলোর সংযোগ ছিদ্রে কপাটিকা থাকে
- বিপরীত প্রবাহে বাধা দেয়
- রুই মাছের কপাটিকা সমূহ একমুখী হয়
কপাটিকা গুলি তিন ধরনের হয়| যথা:
- সাইনো-অ্যাট্রিয়াল কপাটিকা (sino-atrial valve): এই কপাটিকা থাকে সাইনাস ভেনেসাস এবং অ্যাট্রিয়ামের মাঝখানের ছিদ্রপথে |
- অ্যাট্রিও- ভেন্ট্রিকুলার কপাটিকা (Atrio-ventricular valve): এই কপাটিকা থাকে অ্যাট্রিয়াম এবং ভেন্ট্রিকলের মাঝে|
- ভেন্ট্রিকুলো-বাল্বাস কপাটিকা (Ventriculo-bulbus valve): এই কপাটিকা থাকে ভেন্ট্রিকল এবং বাল্বাস আরটারিওসাসের মাঝখানে|
হৃৎপিণ্ডের মাধ্যমে রক্ত সংবহন (Blood circulation through heart):
সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড রক্ত পরিবহন করে। কপাটিকাসমূহের নিয়ন্ত্রণের ফলে হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠগুলোর মধ্যে রক্ত সংবহনের একমুখিতা দেখা যায় এবং এ ধরনের হৃৎপিণ্ডকে এক চড় হৃৎপিণ্ড (single circuit than) বলে। হৃৎপিণ্ডের মধ্য দিয়ে কেবল বিশুদ্ধ রক্ত বাহিত হয় বলে রুই মাছের হৃৎপিণ্ডকে ভেনাস হার্ট বা শিরা হৃৎপিণ্ড বলা হয়ে থাকে।
একটি ছন্দময় তালে হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন অংশ নির্দিষ্ট সময় অন্তর সংকুচিত হয়। প্রথমে সাইনাস ভেনোসাসে সঙ্কোচন ঘটে। পরে ক্রমে অ্যাট্রিয়াম, ভেন্ট্রিকল ও বাল্বাস আর্টারিওসাস সংকুচিত হয়।
হৃৎপিণ্ডের প্রতিবার সঙ্কোচনকে সিস্টোল (systole) বলে। সিস্টোলের পরপরই হৃৎপিণ্ড প্রসারিত হয়ে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। হৃৎপিণ্ডের প্রসারণ প্রক্রিয়াকে বলে ডায়াস্টোল (diastole)। হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন কপাটিকা রক্তের একমুখী প্রবাহ নিশ্চিত করে।
রুই মাছের ধমনিতন্ত্র প্রধানত দুই ধরনের ধমনী নিয়ে গঠিত| যথা:
- রুই মাছের ধমনিতন্ত্র প্রধানত অন্তর্বাহী (afferent) ও বহির্বাহী (efferent) ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি নিয়ে গঠিত।
- হৃৎপিণ্ডের ভেন্ট্রিকল থেকে ভেন্ট্রাল অ্যাওর্টা (অঙ্কীয় মহাধমনি) সৃষ্টি হয়ে সামনের দিকে বিস্তৃত। এ ধমনির গোড়া স্ফীত হয়ে আর্টারিওসাস গঠন করে। এটি হৃৎপিন্ড থেকে ভেন্ট্রাল অ্যাওর্টায় রক্তের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। ভেন্ট্রাল অ্যাওটা থেকে যেসব পার্শ্বীয় রক্তনালি পথে বিশুদ্ধ রক্ত দুপাশের ফুলকায় বাহিত হয় সেগুলো অন্তর্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি।
- পার্শ্বীয় নালিগুলো দিয়ে ঐ রক্ত ডার্সাল অ্যাওটা (মহাধমনি) তে বাহিত হয় সেগুলো বহির্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি।
অন্তর্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনী:
বাল্বাস আরটারিওসাস থেকে সৃষ্ট যেসব পার্শ্বীয় রক্তনালি পথে CO2 সমৃদ্ধ রক্ত দুপাশের ফুলকায় বাহিত হয় সেগুলো অন্তর্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনী।
- ৪ জোড়া
- ১ম,২য়,৩য় ও ৪র্থ জোড়া যথাক্রমে ১ম,২য়,৩য় ও ৪র্থ ফুলকায় প্রবেশ করে
বহির্বাহী ব্রঙ্কিয়াল ধমনী:
ফুলকায় CO2 সমৃদ্ধ রক্ত O2 সমৃদ্ধ হওয়ার পর যে পার্শ্বীয় নালিগুলো দিয়ে ওই রক্ত ডর্সাল অ্যাওর্টায় বাহিত হয় সেগুলো বহির্বাহী ব্রঙ্কিয়াল ধমনী।
চার জোড়া ফুলকা থেকে চার জোড়া বহির্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনির সৃষ্টি হয়। প্রথম বহির্বাহী ধমনি অঙ্কীয়দেশে হাইঅয়েড আর্চের সিউডোব্রাঙ্কে রক্ত বহন করে এবং সিউডোব্রায়ের সম্মুখে অপথ্যালমিক ধমনি (ophthalmic artery) হিসেবে বিস্তৃত হয়। প্রতি পাশের ১ম ও ২য় বহির্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি মিলে লম্বালম্বি পার্শ্বীয় ধমনি বা ল্যাটেরাল অ্যাওর্টা (lateral aorta) গঠন করে।
৩য় ও ৪র্থ বহির্বাহী ব্রাঙ্কিয়াল ধমনি ল্যাটেরাল আওর্টায় উন্মুক্ত হওয়ার আগে একত্রে মিলিত হয়। ল্যাটেরাল অ্যাওর্টা সম্মুখে ক্যারোটিড ধমনিরূপে বিস্তৃত হয় এবং করোটিকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
ডার্সাল অ্যাওর্টা মেরুদণ্ডের নিচে মধ্যরেখা বরাবর লেজ পর্যন্ত প্রসারিত। যাত্রাপথে এটি নিম্নোক্ত প্রধান নালিকাগুলো সৃষ্টি করে:
- সাবক্ল্যাভিয়ান ধমনি (Subclavian artery) : বক্ষপাখনা ও বক্ষচক্রের দিকে বিস্তৃত হয়।
- সিলিয়াকো-মেসেস্টারিক ধমনি (Coeliance-mesenteric artery) : পাকস্থলি, অস্ত্র, যকৃত, অগ্ন্যাশয়, মলাশয় প্রভৃতি আন্ত্রিক অঙ্গে রক্ত পরিবহন করে।
- প্যারাইটাল ধমনি (Parietal artery) : দেহ প্রাচীরে রক্ত সরবরাহ করে।
বহির্বাহী ব্রঙ্কিয়াল ধমনীর কাজ:
- চার জোড়া
- অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত বহন করে
রুই মাছের শিরা তন্ত্র:
কৈশিক জালিকা (blood capillaries) থেকে উৎপন্ন হয়ে, যেসব রক্তনালি দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে অক্সিজেনবিহীন (deoxygenated) রক্ত সংগ্রহ করে হৃৎপিণ্ডের সাইনাস ভেনোসাসে নিয়ে আসে, সেগুলোই সম্মিলিতভাবে শিরাতন্ত্র গঠন করে। রুইমাছের শিরাতন্ত্রকে প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
- সিস্টেমিক শিরাতন্ত্র এবং
- পোর্টাল শিরাতন্ত্র।
পোর্টাল শিরা তন্ত্র হেপাটিক পোর্টালতন্ত্র ও রেনাল পোর্টাল তন্ত্র নিয়ে গঠিত হয়|
রুই মাছের শিরাতন্ত্র গঠন:
- একজোড়া সম্মুখ কার্ডিনাল শিরা
- একজোড়া পশ্চাৎ কার্ডিনাল শিরা
- একটি হেপাটিক পোর্টাল
- একটি রেনাল পোর্টাল শিরা নিয়ে গঠিত
শ্বসন কৌশল (Mechanism of Respiration):
রুই মাছে দুই ধাপে শ্বাসক্রিয়া ঘটে। এক্ষেত্রে ফুলকা প্রকোষ্ঠ চোষণ পাম্প (suction pump) হিসেবে কাজ করে।
১.শ্বাসগ্রহণ বা প্রশ্বাস (Inspiration):
কানকো-দুটি যখন উত্তোলিত হয় তখন ফুলকা প্রকোষ্ঠের মুখ ব্রাঙ্কিওস্টেগাল ঝিল্লি দিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এতে গলবিলে একটি চোষণ-বলের সৃষ্টি হয়। ফলে মুখছিদ্র রক্ষাকারী মৌখিক কপাটিকা খুলে যায় এবং পানি মুখের ভেতর দিয়ে মুখগহ্বরে প্রবেশ করে।
২.শ্বাসত্যাগ বা নিঃশ্বাস (Expiration):
কানকো যখন পেশি-সংকোচনের ফলে নেমে আসে তখন গলবিল ও মুখগহবরে চাপ বেড়ে যায়। সাথে সাথেই মৌখিক কপাটিকা মুখছিদ্রকে বন্ধ করে দেয় এবং ফুলকা-প্রকোষ্ঠের ছিদ্র উন্মুক্ত হয়। পানি তখন এ ছিদ্রপথেই বেরিয়ে যায়। মুখ ও গলবিলের ভেতর দিয়ে অতিক্রমের সময় স্রোতপ্রবাহ নিচে অবস্থিত ফুলকাগুলোকে ভিজিয়ে দেয়।
আরো পড়ুন: রুই মাছের পুষ্টিকর ও সুস্বাদু রেসিপি
রুই মাছের প্রজনন(Reproduction):
স্ত্রী রুই মাছ অপেক্ষাকৃত কম গভীর জলে ও স্রোতের টানে নদীর পাড়ে ডিম ছাড়ে৷ এছাড়াও কৃত্রিম উপায়ে বাঁধ বা পুকুরে স্রোতের সৃষ্টি করা হলে সেখানেও নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়তে পারে।পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় লালগোলা, মালদহ মাণিকচক এবং ধুলিয়ান অঞ্চলে নদী থেকে মাছের ডিম পোনা ব্যাপক ভাবে ধরা হয়।
১। দুই বছর বয়সে রুই মাছ জননক্ষম হয়
২। জুন-জুলাই মাসের দিকে প্রজননের জন্য তৈরি হয়
৩। প্রতি কেজি দেহ ওজনের জন্য ১-৪ লক্ষ ডিম উৎপাদন করে থাকে৩।
৪।স্রোতযুক্ত নদীর পানিতে জনন ঘটে, বদ্ধ পানিতে নয় |
৫। স্ত্রী মাছ ৫১-৭০ সেমি এবং পুরুষ মাছ ৬৫ সেমি লম্বা হলে প্রজননের জন্য তৈরি হয়|
রুই মাছের নিষেক:
১। নিষেকের সময় নদীর পানির তাপমাত্রা থাকে ২৭-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস
২। নদীর জল এসময় ঘোলা থাকে এবং জল ফুলে উঠে
৩। জলে পর্যাপ্ত অক্সিজেন থাকে
৪। দেহের বাইরে নদীর জলে নিষেক হয় বলে একে বহিঃনিষেক বলে
রুই মাছের চাষ:
রুই মাছ দেশি ও কার্প জাতীয় মাছের সাথে মিশ্র চাষ করা হয়| রুই মাছ জলের মধ্যস্তরে থাকার কারণে জলের ওপরের স্তরের মাছ যেমন কাদলা এবং নিজের স্তরের মাছ যেমন কালো কার্পের সাথে চাষ করা হয়। এতে খাদ্য খরচ কম হয়। রুই মাছ চাষের পূর্বে পুকুর প্রস্তুত করা হয় পুকুর প্রস্তুত করার পর পুকুরে জল মজুদ করে একটা নির্দিষ্ট আকারের রুই মাছের পোনা ছাড়তে হয়।
জলের গুনাগুন ঠিক রেখে মাছের মোট ওজনের 3 থেকে 5 শতাংশ সম্পূরক খাবার দৈনিক ৩-৪ বারে দিতে হয়| সম্পূরক খাবার তৈরির জন্য সাধারণত ফিশ মিল, চালের গুড়া, সরিষার খৈল প্রভৃতি বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করা হয় এবং বাজারে রুই মাছের বেস্ট চাহিদা রয়েছে বর্তমানে|
রুই মাছ সংরক্ষণ:
রুই মাছের বিচরণ স্থান গুলিকে মৎস্য অবহেলন্য তৈরি করা
বিভিন্ন পুকুরগুলিকে মৎস্য চাষের জন্য বিশেষভাবে পরিচর্যা করার প্রয়োজন
রুই মাছের জীবন পর্যায়:
রুই মাছ মিষ্টি জলের মাছ| এই মাছ খেতে খুব সুস্বাদু ও উপকারী| রুই মাছের জীবনের ইতিহাস:
- ডিম নিষিক্ত হওয়ার ৩০-৪৫ মিনিট পর বিভাজন বা ক্লিভেজ শুরু হয়
- নিষিক্ত ডিম্বাণু মাইটোসিস বিভাজনের মাধ্যমে ছোট ছোট কোষ বা ব্লাস্টোমিয়ার ফর্ম করে
- ব্লাস্টোডার্ম আর পেরিব্লাস্ট নামে দুইটি স্তর তৈরি করে যাকে একত্রে বলা হয় ব্লাস্টুল
- ব্লাস্টুলা থেকে বিভিন অঙ্গ তৈরি হয় যাকে বলে অরগানোজেনেসিস
- ৫-৬ ঘণ্টা পরে কুসুমের দুই প্রান্ত সরু হয় এবং তখন কুসুম থলি বড় থাকে যা থেকে লার্ভা পুষ্টি গ্রহণ করে
- ১২ ঘণ্টা পর লার্ভার চোখের রঙ কালো হতে থাকে ক্রোমাটোফোরের কারণে
- ২৪ ঘণ্টা পরে ফুলকা আর্চ দৃশ্যমান হয়
- নটোকর্ড পিছনের দিকে ঊর্ধ্বমুখী হয়
- লেজ ও পায়ু-পাখনা স্পষ্ট দেখা যায়
- ৪৮ ঘণ্টা পর লার্ভা লম্বা হয়
- বায়ুথলি দেখা যায়
- ফুলকা আর্চ স্পষ্ট
- ৭২ ঘণ্টা পর কুসুম থলি বিলীন হয়ে যায়
- লার্ভা দশার সমাপ্তি ঘটে
- ৯৬ ঘণ্টা পরে লার্ভার মুখ স্পষ্ট হয়ে খাদ্য গ্রহণ শুরু করে
- কুসুম থলি মিলিয়ে যায়
- ১৫ দিন বয়সে মুখে বারবেল দেখা যায়
- পায়ু, খাদ্যনালী স্পষ্ট হয়
- আইশ দৃশ্যমান হয়না
- দৈহিক গরন মোটামোটি সম্পূর্ণ হয়
- এরপর কেবল আঙ্গিক পরিবর্তন এবং আকারের পরিবর্ধন হয়
রুই মাছ বিষয়ে আপনাদের একটা স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলাম| পুরো লেখাটি পড়ার জন্য আপনাদের জানাই ধন্যবাদ| লেখাটি যদি ভালো লাগে অবশ্যই শেয়ার করবেন এবং কমেন্ট করবেন|
আরও জানুন:
কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল ইতিহাস- মৃৎশিল্প ও শিল্পী
পড়া তাড়াতাড়ি মুখস্থ করার উপায়-পড়া মনে রাখার গোপন রহস্য জেনে নিন
আজও ২০২৪ সালে কি নেতাজিসুভাষ চন্দ্র বসু বেঁচে আছেন? জেনে নিন
জানলে অবাক হবেন ২৬ শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস কেন পালিত হয়